বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০৫:৪৫ পূর্বাহ্ন

বিদায় আলেয়া চৌধুরী

বিদায় আলেয়া চৌধুরী

0 Shares

চারদিকে এত মৃত্যু; মনে হচ্ছে অজস্র লাশের ভেতর সাঁতার কাটছি। মৃত্যু এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন কবিবন্ধু আলেয়া চৌধুরী। খবরটা জেনে মন বিষণ্ণ হয়ে গেলো; মনে পড়লো অনেক স্মৃতি। আমি তাঁর ‘হার্লেমের নিগ্রো আমি’ না ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ গ্রন্থের প্রকাশক—এই মুহূর্তে তা মনে করতে পারছি না।

তাঁর সংগ্রামী জীবন নিয়ে আমার একটি শর্ট ফিল্ম নির্মাণের কথা ছিলো। তাঁর নিউ জার্সিস্থ বাড়িতে বসে আলোচনা করেছি। ঢাকার ধানমন্ডির বাসায় আংশিক স্ক্রিপ্ট হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। যদিও ১৯৯৪ সালে দিনা হোসেন ‘আলেয়া : আ বাংলাদেশি পোয়েট ইন আমেরিকা’ নামে একটি তথ্যচিত্র করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।

আমার কাহিনিটা ছিলো একেবার তাঁর জীবন থেকে নেয়া—গল্পকেও হার মানানো জীবনালেখ্য।

কুমিল্লার অজপাড়া-গাঁ উত্তর চর্থা গ্রামের এক দুরন্ত গ্রাম্য কিশোরী। যার ডাক নাম হীরা। গ্রাম্য শালিশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে পাটখড়িতে আগুন জ্বালিয়ে ছুঁড়ে মারেন সালিশ তথা ফতোয়াবাজদের দিকে। সেজন্য তাঁকে ঝাঁড়ু পেটা করা হয়। বাবাও শান্তি-স্বরূপ বাড়ির সামনে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেন। রাতে মা সেই বাঁধন মুক্ত করে ছেড়ে দিলেন। বললেন, যা পালিয়ে যা… ট্রেনে চড়ে এলেন ঢাকায়। শুরু হলো অন্য রকম এক বস্তিজীবন, ফুটপাতের খুঁপড়ি জীবন, কুলি-মজুরের জীবন, না-খেয়ে থাকার জীবন। এক ট্রাক ড্রাইভারের দয়া হলো। তাঁকে গ্রহণ করলেন পালক কন্যা হিসেবে। কিছুদিন না যেতেই এক্সিডেন্টে মারা যান সেই আশ্রয়দাতা পিতা।

আবার অনিশ্চিত ছন্নছাড়া জীবন, এতিমখানার জীবন, বুয়ার জীবন, ইট ভাঙার কাজ! সংগ্রামী জীবন শুরু করেন রিকশাচালক হিসেবে। তারপর হকার-জীবন। তাঁকে ৫ কপি ফ্রি ইত্তেফাক দেয়া হতো। তা টিকাটুলি থেকে হাঁটতে হাঁটতে এবং পত্রিকা বিতরণ করতে করতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যেতেন বঙ্গবন্ধুর কাছে পত্রিকা দিতে। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তাঁকে সেলাই মেশিন দিতে চান। তখন তিনি আবেদন করলেন পাবলিক বাস চালানোর জন্য অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ড্রাইভার হতে চাইলেন। তা সংবাদ শিরোনাম হলো।

এ সবের পাশাপাশি মন খারাপের কথাগুলো, কষ্টগুলো রোলকরা খাতার পাতায় লেখা শুরু করলেন। ছাপা হতে থাকলো কবিতা। ১৯৭০ সালে বেগম পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়। ‘জীবনের স্টেশনে’ তাঁর প্রথম কবিতার বই, বেরিয়েছিলো ১৯৭৩ সালে।

এলোমেলো জীবনের তাগিদে হঠাৎ একটা ছোট চাকরি হলো ইরান দূতবাসে। কাপড় ইস্ত্রি করা। সেখান থেকে মাত্র আঠারো বছর বয়সে অনেকটা ‘পাচার’ হওয়া জীবনের মতো চলে যান ইরানে। শুরু হলো আরেক পরবাসী বোহিমিয়ান জীবন। সেখান থেকে জার্মানে। জার্মান থেকে যাযাবরের মতো একদিন চড়ে বসলেন মাছ ধরার ট্রলারে। সেই জাহাজ চলতে থাকে অজানার দিকে। এভাবে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে প্রচণ্ড শীত ও বরফের সাথে জীবন-মরণ লড়াই করে পৌঁছলেন বাহামার এক সৈকতে। সেখান থেকে এক লোক উদ্ধার করে স্ত্রীর ভয়ে তাকে গ্যারেজে লুকিয়ে রেখে পরদিন শহরে পৌঁছে দেন। সেখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তখন তার বয়স কুড়ি। এসব কাহিনি—ভয়াবহ।

তার লড়াকু জীবনের স্বীকৃতি-স্বরূপ নিউইয়র্কের স্টার ম্যাগাজিন ‘উইমেন অব দ্য ইয়ার’ শীর্ষক প্রচ্ছদ কাহিনি প্রকাশ করেছিলো। স্বশিক্ষিত আলেয়া ধীরে ধীরে দাঁড়ালেন নিজের পায়ে। কিন্তু তখন তিনি কিছুটা ক্লান্ত। সেই সাথে শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার। ইতোমধ্যে কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। আর্থিকভাবেও স্বচ্ছল হন। জিউ জার্সিতে একটি ফ্ল্যাট এবং আরেকটি বাড়ি করেন। ঢাকায় সম্ভবত গোড়ানে জমি কিনেন; ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট কিনে ভাই-বোনদের দেন। সেই কৈশোরে ঢাকায় থাকার সময় বিয়ে করেছিলেন কবি শাহাদাত বুলবুলকে। কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আলেয়ার আবার স্বপ্ন ছিলো সংসারের। কিন্তু তা আর হলো না।





প্রয়োজনে : ০১৭১১-১৩৪৩৫৫
Design By MrHostBD
Copy link
Powered by Social Snap